প্রকাশ: ২০ জুন, ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
ফুটবল মানেই আবেগ, আর সেই আবেগের কেন্দ্রবিন্দুতে যদি থাকেন লিওনেল মেসি, তাহলে মুহূর্তগুলো হয়ে ওঠে ঐন্দ্রজালিক। বয়সের ঘড়ি ৩৭ পার করেও যেন থেমে নেই সময়ের সেরা জাদুকর। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে পর্তুগিজ ক্লাব পোর্তোর বিপক্ষে ২-১ গোলের জয়ে ইন্টার মায়ামির হয়ে আবারও প্রমাণ করলেন, তার পায়ে এখনও সেই জাদুর স্পর্শ বর্তমান।
ম্যাচে পিছিয়ে পড়েও দৃঢ় প্রত্যয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ইন্টার মায়ামি। তরুণ মিডফিল্ডার তেলাস্কো সেগোভিয়ার গোলে সমতায় ফেরার পর দ্বিতীয়ার্ধে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যার জন্য অপেক্ষায় ছিল গোটা বিশ্ব। ২০ গজ দূর থেকে পাওয়া ফ্রি-কিক থেকে গোল করা যেন মেসির জন্য দৈনন্দিন কাজের মতো। প্রতিপক্ষ গোলরক্ষক ক্লদিও রামোস শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারেননি, যেমনটা আগেও বহুবার দেখা গেছে। সেই পুরোনো বার্সেলোনার মেসির মতোই নিখুঁত কারুকাজে বলটি মানব-দেয়াল টপকে ঠিক জায়গামতো জালে ঠাঁই নেয়।
এই গোলের মাধ্যমে মেসি নিজের সরাসরি ফ্রি-কিকে তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতার অবস্থান নিশ্চিত করেছেন, তার ফ্রি-কিক গোল সংখ্যা এখন ৬৮। তার চেয়ে এগিয়ে আছেন কেবল ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি জুনিনহো পারনামবুকানো (৭৭) ও ফুটবলের কালো মানিক পেলে (৭০)।
সাবেক পর্তুগিজ ডিফেন্ডার হোসে ফন্তে মন্তব্য করেন, “মেসির পায়ে যেন ঈশ্বরের ছোঁয়া রয়েছে।” আর সাবেক ইংলিশ গোলরক্ষক শে গিভেন বললেন, “ফ্রি-কিক তার জন্য যেন পেনাল্টির মতো, এক কথায় জাদুকর।”
মেসির এই অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের ম্যাচেই ইতিহাস গড়েছে ইন্টার মায়ামি। ক্লাব বিশ্বকাপে কোনো এমএলএস (মেজর লিগ সকার) ক্লাবের পক্ষে প্রথমবারের মতো কোনো ইউরোপীয় দলকে হারানোর কীর্তি অর্জন করে তারা। এখন গ্রুপ ‘এ’-এর শেষ ম্যাচে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব পালমেইরাসের বিপক্ষে ড্র করলেই শেষ ষোলোয় পা রাখবে মেসির দল।
এটি ছিল মেসির ইন্টার মায়ামির হয়ে ৬১তম ম্যাচ এবং তাতে তার গোলসংখ্যা দাঁড়াল ৫০-এ। এই সংখ্যাটি তাকে ক্লাবটির সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা আরও বিস্ময় জাগায়, যখন জানি ক্লাবটির পথচলা শুরু হয়েছিল মাত্র ২০১৮ সালে।
বার্সেলোনার হয়ে তিনি ক্লাব বিশ্বকাপে পাঁচটি গোল করেছিলেন, যার মধ্যে তিনটি ছিল ফাইনালে। ২০০৯, ২০১১ ও ২০১৫ সালের বার্সা জয়ে ছিল তার অসাধারণ অবদান। সব মিলিয়ে তার ক্লাব ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত গোল সংখ্যা দাঁড়াল ৭৫৪। ক্লাব বিশ্বকাপে তার গোল সংখ্যা ৬—যা গ্যারেথ বেল ও করিম বেনজেমার সমান। এগিয়ে আছেন কেবল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (৭টি)।
তবে শুধু গোল নয়, গোটা ম্যাচে মেসির প্রভাব ছিল অনন্য। তিনি করেন ম্যাচের সর্বোচ্চ ড্রিবল (২টি), বল স্পর্শের সংখ্যায় ছিলেন তৃতীয় (৭০টি), পাস অ্যাটেম্পটে পঞ্চম (৫৬টি)। তার চেয়েও এগিয়ে ছিলেন কেবল সতীর্থ সার্জিও বুস্কেটস (৮৫) এবং প্রতিপক্ষের মিডফিল্ডার ফাবিও ভিয়েরা (৯৯)।
সাবেক স্কটিশ মিডফিল্ডার ডন হাচিসন বলেন, “মেসি শুধু পাস দেন না, খেলার রাশটাই নিজের হাতে তুলে নেন। বল হারান না, বরং খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেন। এখনও তার পা দুটো সত্যিই বিস্ময়কর।”
৩৮ বছরে পা রাখার আগেই মেসি যেন নিজেকে আবারও নতুন করে চিনিয়ে দিলেন বিশ্বমঞ্চে। ইন্টার মায়ামি এখন শুধু একদল খেলোয়াড়ের সমাহার নয়—এটি হয়ে উঠেছে বার্সেলোনার সেই স্বর্ণালি প্রজন্ম ও উদীয়মান আমেরিকান প্রতিভার এক অনন্য সংমিশ্রণ। মেসি, সুয়ারেজ, বুস্কেটস, জর্দি আলবার মতো কিংবদন্তিরা এখন এই নতুন দলের প্রাণ।
ইন্টার মায়ামির কোচ ও সাবেক আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার হাভিয়ের মাশ্চেরানো বলেন, “আজ আমরা প্রমাণ করলাম—আমরা যেকোনো দলের বিপক্ষে লড়তে পারি। এটা কেবল আমাদের নয়, পুরো আমেরিকার ফুটবলপ্রেমীদের জন্যই গর্বের বিষয়।”
মেসির এই পারফরম্যান্স আরেকবার বুঝিয়ে দিলেন, বয়স তার গায়ে ছোঁয়া দিতে পারলেও, ফুটবলীয় জাদু এখনও অমলিন। মাঠে তার প্রতিটি ছোঁয়া এখনও অনন্ত বিস্ময়ের জন্ম দেয়। বিশ্বমঞ্চে মেসি মানেই ফুটবল জীবন্ত হয়ে ওঠা—আর সেটা আবারও নতুন করে টের পেল বিশ্ব।