নিজস্ব সংবাদদাতা: ঢাকা, ১৩ই মে’ ২০২৫:
বাংলাদেশের নিরাপত্তা খাতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে একটি থিঙ্ক ট্যাংক “ওসমানী সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিস” প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। নামটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সেনানায়ক এম এ জি ওসমানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাখা হলেও এর পেছনের লক্ষ্য ও সম্পৃক্ততাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানামুখী প্রশ্ন ও বিতর্ক।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহফুজ, যিনি দীর্ঘ সময় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে PSO (Principal Staff Officer) এবং পরে Armed Forces Division (AFD)–তে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অবসরের পরও চাকরির মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি পান, যা সরকারের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতার একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, মাহফুজ বর্তমানে ডিজিএফআই-এর পে রোলে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন, যা এই থিঙ্ক ট্যাংকটির রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা সম্পর্কিত অবস্থানকে আরও জোরদার করে তুলেছে।
বিশ্বস্ত সূত্রের বরাতে জানা যায় ২০২৫ সালের ৮ মে মাহফুজ একটি প্রকাশ্য বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সেনাশাসনকালে কুখ্যাত এবং বিতর্কিত দুই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা—লেফটেন্যান্ট জেনারেল মামুন খালেদ এবং মেজর জেনারেল রেজা নূর। এই দুই জেনারেলের বিরুদ্ধে রয়েছে:
গুম, হত্যা, এবং বরখাস্তের মত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
বিপুল অঙ্কের সম্পদের মালিকানার প্রমাণ
“আয়না ঘর” নামে পরিচিত এক গোপন নির্যাতন চক্রের নেতৃত্ব
তাদের সঙ্গে মাহফুজের এই বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে যে, নতুন এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান আদতে কি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নাকি রাজনৈতিক পুনর্গঠনের অংশ?
এই থিঙ্ক ট্যাংকে যুক্ত আছেন আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ সাবেক সেনা কর্মকর্তা:
মেজর জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুব সারোয়ার
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তফা কামাল রুশো
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউসুফ
উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠানের তহবিলের উৎস সরাসরি ডিজিএফআই, যা এটিকে সরকারপন্থী একটি প্রভাবিত থিঙ্ক ট্যাংক হিসেবেই চিহ্নিত করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই থিঙ্ক ট্যাংকটির মূল উদ্দেশ্য জাতীয় নিরাপত্তার ছদ্মাবরণে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ সামরিক চক্রের স্বার্থরক্ষা, এবং বিভিন্ন ফোরামে তাদেরকে ‘নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
এই প্রকল্পে জড়িত আরও তিন বিতর্কিত কর্মকর্তা হলেন:
সিজিএস লে. জে. শামীম
ডিএমআই ব্রি. জে. আজাদ
এএসইউ কমান্ডান্ট ব্রি. জে. শামস
তিনজনকেই জেনারেল ওয়াকারের বিশ্বস্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সামরিক সূত্র জানায়, মামুন খালেদ ও রেজা নূরের মতো কর্মকর্তারা আজও সেনানিবাসে অনায়াসে বিচরণ করছেন—যা একদিকে সেনা শৃঙ্খলা, অন্যদিকে জাতির নৈতিক মানদণ্ডে প্রশ্ন তোলে।
এছাড়া, পূর্বে দেশ ছেড়ে পালানো বিতর্কিত কর্মকর্তাদের (যেমন: লে. জে. মুজিব, মে. জে. সাইফ, মে. জে. তাবরেজ, ও মে. জে. হামিদ) পরিবারবর্গ সেনানিবাসে এখনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। এর মাধ্যমে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিরবতা এবং রাজনৈতিক ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
একটি আধুনিক ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার নামে শুরু হওয়া এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে উঠে আসছে প্রশ্ন—এটি কি আদৌ নিরাপত্তা সংক্রান্ত গবেষণার নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম, নাকি ক্ষমতাসীনদের ‘সামরিক মুখপাত্র’ তৈরির প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই উদ্যোগ বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর একটি বড় ধরনের প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে।