প্রকাশ: ১৭ জুন, ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশের বিচার বিভাগে আনিসুল হক ও কামরুল ইসলাম নামে দুই রাজনৈতিক নেতার নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং তার প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ছিলেন বিচার বিভাগের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিসহ বিভিন্ন বিষয় নির্ধারণে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী। তাদের নেতৃত্বে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়, যেখানে রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশে শত শত অবৈধ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পেয়েছেন, যারা এখনো মন্ত্রণালয়ের অধস্তন বিভিন্ন আদালত ও নিবন্ধন অধিদপ্তর (আইজিআর) নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন।
আর্থ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ঘোষিত নেতা ও কর্মীদের বিচার বিভাগে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া এবং জামিনসহ বিশেষ সুযোগ-সুবিধার প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য এই নিয়োগবাণিজ্যের মাধ্যমে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তবে এক বছর পার হলেও, এ বিষয়ে এখনো কোনো গঠনমূলক তদন্ত শুরু হয়নি।
মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার ও সংশ্লিষ্ট সূত্র যাচাই করে দেখা যায়, গত ১৬ বছরে দেশের প্রায় সব জেলা প্রশাসনিক আদালত ও নিবন্ধন অধিদপ্তরে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি কর্মী রাজনৈতিক কোটার ভিত্তিতে অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ভোলা সহ অধিকাংশ জেলা এসব নিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু।
উল্লেখযোগ্য একটি উদাহরণ হিসেবে গাজীপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাজির শাহ মো. মামুনকে দেখা যায়, যিনি ২০১২ সালে সরাসরি সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের সুপারিশে এই পদে নিয়োগ পান। যদিও তিনি ভোলার বাসিন্দা, কিন্তু নিজেকে ঢাকার বাসিন্দা দাবি করে নিয়োগের জন্য জালিয়াতি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কামরুল ইসলামের সহযোগিতায় তিনি দীর্ঘদিন ওই আদালতে প্রভাব বিস্তার করেন এবং ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধিও করেন।
২০১৯ সালের অক্টোবরে গ্রেফতার হওয়া কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগে প্রভাব বিস্তার ও দুর্নীতির অভিযোগে চট্টগ্রামে বদলি করা হলেও, দলের স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে গাজীপুরে ফিরে আসেন এবং পুনরায় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ফিরে পান। মামুন এখনো গাজীপুরের অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং নিজেই স্বীকার করেন যে তিনি কামরুল ইসলামের রাজনৈতিক লোক।
রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও আনিসুল-কামরুল সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন অবৈধ নিয়োগ কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। উদাহরণ হিসেবে খুলনা অঞ্চলে গত দুই বছরেই আনিসুল হকের সুপারিশে ৬৬ জন কর্মচারী নিয়োগ পেয়েছেন, যাদের মধ্যে ২২ জন আনিসুল হকের এলাকার বাসিন্দা। একইভাবে পঞ্চগড় ও সিরাজগঞ্জ আদালতেও অনেক কর্মী তার সুপারিশে নিয়োগ পেয়েছেন।
এছাড়াও, নোয়াখালীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নাজির পদে ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহকে নিয়োগ দেওয়া হয় আনিসুল হকের সুপারিশে। সুনামগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন আদালতেও তার রাজনৈতিক ক্যাডার নিয়োগ পান। ভোলার জালিয়াতি ও অবৈধ নিয়োগের ঘটনায় হাইকোর্টে মামলা হলেও তা দীর্ঘদিন আটকে রয়েছে এবং প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারণে এসব নিয়োগ বহাল তবিয়তে রয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম জানান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে নিচু আদালতের কর্মচারী নিয়োগের সময় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার কথা বিভিন্ন পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। যদিও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা এই বিষয়ে মন্তব্য করতে অনিচ্ছুক।
বিচার বিভাগে আনিসুল-কামরুল সিন্ডিকেটের এই অবৈধ নিয়োগ ও ক্ষমতার অপব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা একটি সংকটের নাম। এর ফলে দেশের বিচার বিভাগে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বিপন্ন হয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে দ্রুত এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশের বিচার বিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।